

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে কি টাইম ট্রাভেল করা সম্ভব।।
মহাবিশ্বকে দেখার শখ মানুষের চিরকালের। মহাবিশ্বের অজানা রহস্যের সমাধানের শুরু বহু পূর্বে হলেও,... আরও পড়ুন!
পড়ার সময়
Mins
মোট শব্দ
Words
দৃশ্য
59
মন্তব্য
0
প্রকাশের তারিখ
13 May 2025
মহাবিশ্বকে দেখার শখ মানুষের চিরকালের। মহাবিশ্বের অজানা রহস্যের সমাধানের শুরু বহু পূর্বে হলেও, গ্যালিলিও-কোপার্নিকাস সময়কালকে মুলত মহাকাশ গবেষণার প্রকৃত সূত্রপাত হিসাবে ধরা হয়। তবে মহাকাশ গবেষণা ও মানুষের মহাবিশ্ব জয়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয় ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কাল থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মধ্যে বিশ্বের সুপার পাওয়ার হওয়ার প্রতিযোগিতা ঠান্ডা যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করে। উভয় দেশ একে অপরের থেকে শ্রেষ্ট প্রমাণ করার লক্ষ্যে মহাকাশ গবেষণায়ও প্রতিযোগিতা শুরু করে। তবে পরবর্তী কালে এই প্রতিযোগিতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যায়। এর কারন সরূপ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, গৃহযুদ্ধ, সাম্যবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রভৃতি।
মহান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও-এর সময়কাল থেকে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে বিভিন্ন জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহাকাশের জট খোলার জন্য একের পর উন্নত দূরবীক্ষণ যন্ত্রের অবিষ্কার করে গেছেন। তবে অতীতের সমস্ত দূরবীক্ষণ যন্ত্রের চেয়ে অনেক গুণ শক্তিশালী, উন্নত প্রযুক্তির দূরবীক্ষণ যন্ত্র মার্কিন মহাকাশ গবেষনা সংস্থা কর্তৃক মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। এই অত্যাধুনিক দূরবীক্ষণ যন্ত্রের নাম জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (James Webb Space Telescope)।
বিজ্ঞানীদের দাবি এই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে একপ্রকার টাইম ট্রাভেল বা সময় যাত্রা করা সম্ভব। শুনতে অবাক লাগলেও এই অত্যাধুনিক টেলিস্কোপের সাহায্যে অতীতে মহাবিশ্বে ঘটে যাওয়া মহাজাগতিক সব ঘটনার চিত্র পাওয়া সম্ভব। এখানে অতীতের কয়েক বছরের মহাজাগতিক ঘটনার চিত্রের কথা বলা হচ্ছেনা। বরং জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে মিলয়ন-বিলিয়ন বছর পূর্বের মহাজাগতিক বিবর্তনের চিত্র পাওয়া সম্ভব। উদাহরণ সরূপ আজ থেকে প্রায় 13 বিলিয়ন বছর পূর্বে বিগ ব্যাং বা মহাবিশ্বের শুরু সময়কার বিবরণ পাওয়া সম্ভব।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ কিভাবে ও কি উপায়ে কাজ করবে?
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের বৈশিষ্ট্য হল অবলোহিত রশ্মি সনাক্ত করণের মাধ্যমে কাজ করে। এখানে জেনে রাখা ভাল সাধারণ টেলিস্কোপে দৃশ্যমান আলোক রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য দেখা যায়। আমরা খালি চোখে যে আলোক তরঙ্গ দেখি তা দৃশ্যমান রশ্মি। দৃশ্যমান রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘের ব্যাপ্তি নীল থেকে লাল রং পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং লাল রঙের সবচেয়ে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ হয়।
আমরা জানি তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের যত বড় তরঙ্গদৈর্ঘের হয় ঠিক ততটাই সহজেই কোন বস্তুকে অতিক্রম করতে পারে। উদাহরণ হিসাবে বেতার স্টেশন থেকে রেডিও তরঙ্গ যেভাবে বড় বড় বিল্ডিং বা ইমারতের বাঁধা সহজেই অতিক্রম করে বেতার যন্ত্র অব্দি পৌঁছায়। এর কারণ রেডিও তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ব্যাপ্তি কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
রেডিও তরঙ্গদৈর্ঘের তুলনায় আবার অবলোহিত রশ্মি তরঙ্গদৈর্ঘের ব্যাপ্তি অনেক গুণ বেশি হয়ে থাকে। অবলোহিত রশ্মি তরঙ্গ দৈর্ঘ্য খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। তবে টেলিস্কোপে অবলোহিত রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘের ব্যবহারে সুবিধা হল মহাকাশের গ্যাসের ও ধূলিকনার মেঘকে সহজেই অতিক্রম করে স্পট ছবি ক্যামেরা বন্ধি করতে পারে। অর্থাৎ অবলোহিত রশ্মি দ্বারা নেওয়া টেলিস্কোপের ছবি আরো বেশি পরিষ্কার ও বিস্তারিত হয়। নিচে অবলোহিত রশ্মি ও দৃশ্যমান রশ্মি তরঙ্গদৈর্ঘের মধ্যমে ধারণ করা ছবি দেখে উভয়ের পার্থক্য সহজেই বোঝা সম্ভব।
হেলিক্স নেবুলার ইনফ্রারেড/দৃশ্যমান আলোর তুলনামূলক দৃশ্য (Photo by eso.org)
“Infrared” একটি লাতিন শব্দ যার অর্থ “Below Red”, অর্থাৎ অবলোহিত রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য লালের নীচে হয়। আমরা জানি যে সব বস্তু থেকে তাপ বিকিরণ হয় সেখান থেকেই অবলোহিত রশ্মি উৎপন্ন হয়। যেমন নক্ষত্র, মানুষ, প্রাণী ইত্যাদির থেকে অবলোহিত রশ্মি উৎপন্ন হয়।
যেহেতু এই দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে বিশ্বব্রহ্মণ্ডে বিভিন্ন নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জ, সৌর মণ্ডল প্রভৃতিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য ব্যবহার করা হবে এবং এই সবই বস্তু তাপ বিকিরণ করে। সেকারনে অবলোহিত রশ্মি ব্যবহার করে বিশ্বব্রহ্মণ্ডে বিভিন্ন স্থানের সঠিক ও উন্নত চিত্র ক্যামেরায় ধারণ করা সম্ভব।
এছাড়া পৃথিবী থেকে ওই সব নক্ষত্র ও নক্ষত্রপুঞ্জ মিলিয়ন-বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে থাকার কারনে তাদের থেকে বিকিরিত অলোক তরঙ্গ দৈঘ্য ক্রমে বড় হতে শুরু করে। সে কারনে নক্ষত্র ও নক্ষত্রপুঞ্জ-এর উচ্চ মাণের ছবি তোলার জন্য বড় মাপের আয়না ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে দূরবীক্ষণ যন্ত্রে। যত বড় আয়না হবে তত বেশি আলোক তরঙ্গ গ্রহণ করতে পারবে। ফলসরূপ ছবি মান উচ্চ মাণের হবে। সেকারনে আধুনিক সময়ে নির্মিত দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আয়না পূর্বের দূরবীক্ষণ যন্ত্রে ব্যবহৃত আয়নার তুলনায় বড় করা হয়। উদাহরণ সরূপ James webb telescope ও Hubble telescope-এর আয়নার পার্থক্যের কথা উল্ল্যেখ করা যেতে পারে।
James Webb telescope vs Hubble telescope mirror (Photo by Reddit)
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের গঠন ও ইতিহাস
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা 25শে ডিশেম্বর 2021 সালে মানব সভ্যতার সেরা আবিষ্কার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপকে মহাবিশ্বের গবেষণার জন্য মহাকাশে পাঠায়। নাসা ছাড়াও ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ও কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি যৌথভাবে JWST টেলিস্কোপ নির্মানে সাহায্য করেছে। নাসার কর্ম কর্তাদের মতে এই টেলিস্কোপের নির্মানে 30 বছরের অধিক সময় ধরে কাজ করেছে তারা। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ তৈরি করতে মোট খরচ হয়েছে 10 বিলিয়ন ডলার।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের আয়না 18 টি ষড়ভুজাকার পৃথক পৃথক আয়নার সম্মনয়ে গঠিত। 21.3-ফুট-প্রশস্ত (6.5 মিটার) স্মমিলিত আয়নার প্রতিটি 24 ক্যারেট সোনার ধাতুপট্টাবৃত। কারন সোনা সবচেয়ে ভালো ভাবে লাল আলোকে প্রতিফলিত করতে পারে।
টেলিস্কোপের নিজস্ব শরীর থেকে সৃষ্ট অবলোহিত রশ্মি যেন দূর মহাকাশের নক্ষত্র ও নক্ষত্রপুঞ্জের প্রতিফলিত অবলোহিত রশ্মি তরঙ্গদৈর্ঘের যেন ব্যাঘাত না ঘটায় এবং টেলিস্কোপের তাপমাত্রা কম রাখতে টেলিস্কোপ আয়নার চারিপাশে একটি সানশিল্ড লাগানো হয়েছে। সানশিল্ডের আয়তন একটি টেনিস খেলার অঙ্গণের (21.197 m x 14.162 m) সমান। 5 স্তরের Kapton নামের একটি কৃত্রিম উপাদান দিয়ে তৈরী সানশিল্ড টেলিস্কোপকে ঠান্ডা করতে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রত্যেক সানশিল্ড স্তর মানুষের চুলের থেকেও হালকা। প্রতিটি স্তর অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে প্রলেপযুক্ত। এছাড়া দুটি উষ্ণতম স্তরর (সূর্যের দিকের স্তর 1 এবং স্তর 2) "Doped-silicon" বা চিকিত্সা ক্ষেতে ব্যবহার করা সিলিকন আবরণ রয়েছে যাতে সূর্যের তাপকে মহাকাশে প্রতিফলিত করে।
Hubble telescope-এর মত জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপকে কাছাকাছি না রেখে পৃথিবী থেকে 1.5 মিলিয়ন কিমি দূরে L2 পয়েন্টে স্থাপন করা হবে। তার কারন এই স্থানে সূর্য ও L2 পয়েন্টের মাঝে পৃথিবীর অবস্থানের কারন পৃথিবীর ছায়া সৌর বিকিরণের হাত থেকে টেলিস্কোপের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখা সম্ভব। এছাড়াও L2 পয়েন্ট পৃথিবীর কক্ষপথের সমান্তরালে চলতে থাকে।
L2 পয়েন্টে (Photo by Webb space telescope)
মহাকাশ গবেষনায় জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের গুরুত্ব
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে মহাবিশ্বের অনেক অজানা অংশের চিত্র ক্যামেরা বন্ধী করা সম্ভব। প্রসঙ্গত উল্ল্যেখ্য জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে বিগ ব্যাং-এর সময় কালের গ্যাস মেঘ ও ধুলিকনা থেকে গ্রহ, নক্ষত্র ও ছায়াপথ সৃষ্টি ও মহাবিশ্বের বৃদ্ধির এক ঝলক দেখা সম্ভব। এর পূর্বে Hubble telescope-এর সাহায্যে 1 বিলিয়ন বছর পূর্বের ছবি দেখা সম্ভব ছিল কিন্তু James webb telescope-এর দ্বারা 12.8 বিলিয়ন বছর পূর্বের ছবি দেখা সম্ভব। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতে এক প্রকার সময় যাত্রা সম্ভব এই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে। অর্থাৎ এই টেলিস্কোপ একপ্রকার “টাইম মেশিন” বলা যেতে পারে।
কিন্তু অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কি সম্ভব সময় যাত্রা? এই প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে আলোর গতির সাথে। উদাহরণ সরূপ শনি গ্রহ থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে প্রায় 5,333 সেকেন্ড বা 1.50 ঘন্টা। যদি শনি গ্রহ যদি কোন ভাবে ধবংস হয় তাহলে পৃথিবীর মানুষ তা 5,333 সেকেন্ড বা 1.50 ঘন্টা সময় বাদে জানতে পারবে।
আমরা জানি মহাকাশে দূরত্বকে আলোকবর্ষ হিসেবে মাপা হয়। অর্থাৎ 1 বছরে আলো যে দূরুত্ব অতিক্রম করে তাকে 1 আলোকবর্ষ বলে। সেই হিসাবে পৃথিবী ও শনি গ্রহের মধ্যেকার দুরত্ব 1.5 আলোকবর্ষ। আমাদের সৌর মণ্ডল যে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত তার নাম “আকাশ গঙ্গা”। “আকাশ গঙ্গা” গ্যালাক্সির একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে অতিক্রম করতে 1,25,000 আলোকবর্ষ সময় লাগে। অবাক করা বিষয় হল এরকম মিলিয়ন-বিলিয়ন গ্যালাক্সি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আছে এবং সেই সব বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অবস্থিত নক্ষত্র থেকে উৎপন্ন আলো খালি দেখা সম্ভব নয় কিন্তু টেলিস্কোপের মাধ্যমে সম্ভব।
Share this article :
